আমি সব সময় খুব আয়োজন করে লম্বা সময় ধরে পড়তে বসতাম
|আমি আর আমার বোন, আমরা পিঠাপিঠি ভাই-বোন। ও আমার বছর দুয়েকের বড় হবে। তবে আমরা এক’ই সাথে স্কুল-কলেজে পড়েছি। মানে এক’ই ব্যাচে এসএসসি-এইচএসসি পাশ করেছি।আমি সব সময় খুব আয়োজন করে লম্বা সময় ধরে পড়তে বসতাম। আর আমার বোন বলবে- এতো পড়তে বসার কি আছে। আমি পড়তে শুবো! মানে হচ্ছে- ও শুয়ে শুয়ে পড়তো!তখন অবশ্য আমরা অনেক ছোট। শুয়ে শুয়ে পড়লেও হতো। বেশির ভাগ সময় ও ঘুমিয়ে যেত। আমাদের বড় বোন এসে বকা দিয়ে ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলত।
আমি এমন কিছু নেই যেটা মুখস্ত করতাম না! সব কিছু মুখস্ত করে ফেলতাম! হাজার হোক, বেশি নাম্বার পেতে হবে তো! সম্পাদ্য-উপপাদ্য, ভাবসম্প্রসারণ থেকে শুরু করে এমনকি ট্রন্সলেশন পর্যন্ত আমি মুখস্ত করে ফেলতাম।আর আমার বোন এইসবের ধারে কাছে দিয়েও যেত না। ওর একটাই কথা- এইসব মুখস্ত করা কিভাবে সম্ভব! সব বানিয়ে দিয়ে আসব। ও এমনকি পরীক্ষায় পাটীগণিত- বীজগণিত থেকে শুরু করে সকল কিছু নিজের মতো বানিয়ে দিয়ে আসতো! জীবনেও যে অংক করে নাই। কিছুই জানে না! সেই অংকও সে বানায়ে দিয়ে আসতো!
ছোট বেলায় গানের স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছে। প্রথম দিন গানের টিচার বলেছে- সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা শিখলেই গান শেখা হয়ে যাবে। প্রথম ক্লাস করে এসে আমার বোন ঘোষণা করেছে- সা-রে-গা-মা দিয়ে আবার কিভাবে গান শেখা সম্ভব? এটা তো অনেক জটিল বিষয়! আমাকে দিয়ে এইসব হবে না। আমি আর যাচ্ছি না গানের ক্লাসে!
আর আমার ব্যাপার হচ্ছে- কেউ যদি আমাকে এসে বলে শুধু “সা” শিখলেই গান শেখা যাবে। আমি ভাববো- “সা” দিয়ে নিশ্চয় জগতে অন্যরাও গান শিখেছে। অন্যরা পারলে আমি পারব না কেন! দেখা যাবে আমি এর শেষ পর্যন্ত দেখে ছাড়ব।তো, আমাদের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। আমি ওর আগে রেজাল্ট পেয়েছি। পাওয়ার পর বাসায় বসে আমার সেকি কান্না! লোকে হয়ত ভাববে- আমি মনে হয় ফেল করেছি!
খানিক বাদে দেখি আমার বোন হাসতে হাসতে স্কুল থেকে ফিরেছে! আমি ভাবলাম- ও নিশ্চয় আমার চাইতে ভালো রেজাল্ট করেছে। এরপর জানা গেল- ও টেনেটুনে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে! এতে’ই ওর আনন্দের কোন সীমা নেই!
আর আমি?সেই যে কান্নাকাটি শুরু করেছি! সেই কান্নাকাটি মনে হয় সপ্তাহ খানেক ছিল।
আমার মনে আছে আমার এক মামাত ভাই রেজাল্ট দেয়ার পর বাসায় এসে দেখে আমি হাউমাউ করে কাঁদছি! আমাকে দেখে এরপর সে প্রশ্ন করেছে- টুটুল ভাই (আমার ডাক নাম) কি ফেল করেছে নাকি?অথচ আমি সব বিষয়ে লেটার মার্ক্স পেয়ে রীতিমত অনেক ভালো রেজাল্ট করেছি! তো, আমি কাঁদছিলাম কেন? আমার মনে হচ্ছিলো- আরেকটু ভালো করলে কি এমন ক্ষতি হতো!তো আমার বোন আর ওর জামাই আমি যেই শহরে এখন থাকি; বিদেশের এই শহরেই ছিল গত তিন বছর। ওর জামাই এখানে পিএচডি করছিল। ওরা ফেরত গিয়েছে দেশে মাস কয়েক আগে।
আজকাল প্রায়’ই আমাদের ফ্যামিলি গ্রুপে (হোয়াটস এপে) দেখি ভাই-বোনরা; ওদের ছেলে-মেয়েরা মিলে এখানে ওখান যাচ্ছে, এটা-ওটা খাচ্ছে এইসব আলোচনা চলছে।তো, গত পরশু দেখি আমার এই বোন গ্রুপে মেসেজ দিয়েছে- সবাই কিন্তু সাথে চামুচ নিয়ে নিস।আমি এই টেক্সট দেখে বিদেশ থেকে ভাবলাম- ঘটনা কি। ওরা চামুচ নিয়ে কই যাচ্ছে। তো প্রশ্ন করলাম- তোরা চামুচ নিয়ে কই যাস?
তো আমার সেজ বোনের ছেলে উত্তর দিয়েছে – আমরা বেইলি রোডে যাচ্ছি আজ সন্ধ্যায় খাওয়া দাওয়া করতে। এই জন্য ছোট খালামনি সবাইকে চামুচ নিয়ে যেতে বলেছে।
আমি ঠিক বুঝেই উঠতে পারছিলাম না- ওরা বেইলি রোডে খেতে যাচ্ছে; সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু চামুচ নিয়ে যেতে হবে কেন!
তো গতকাল কথা হচ্ছিলো, জিজ্ঞেস করলাম-তোরা চামুচ নিয়ে কেন খেতে বের হলি?- আরে করোনা কাল না। চটপটি খেতে গেলে ওদের চামুচ দিয়ে কিভাবে খাবো। এই জন্য সবাই চামুচ নিয়ে গিয়েছিলাম।এইটা শুনে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না-কি বলা উচিত! করোনার মাঝে ওরা দিব্যি বেইলিরোডে চলে গিয়েছে। চটপটি ওয়ালার দেয়া বাটি’তে করে দিব্যি চটপটিও খেয়েছে! তাহলে আলাদা চামুচ নেয়ার কি মানে? অথচ ওরা সবাই ঠিক ঠিক চামুচ নিয়ে’ই খেতে বের হয়েছে!
তো, এই হচ্ছে আমি আর আমার বোনের মাঝে পার্থক্য। আমার এই লেখা লেখার কোন উদ্দেশ্য নেই। স্রেফ এলোমেলো ভাবনা। হঠাৎ করে মনে হলো- যাপিত জীবনটা বোধকরি সহজ থাকাই ভালো। আপনি যত বেশি চিন্তা করবেন। যত বেশি এটা-ওটার পেছনে ছুটবেন; তত বেশি নিজেকে অতৃপ্ত মনে হবে।জীবনের এই পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে- আমার বোন যেখানে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে কি আনন্দটা’ই না উদযাপন করেছে। আর আমি কিনা সকল বিষয়ে লেটার মার্ক সহ হুলস্থুল রেজাল্ট করেও কেঁদে বেড়িয়েছি। অথচ ওই সময়টা আর কখনো ফেরত আসবে না।