আমি জানি প্রকৃতির শিক্ষা বড্ড কঠিন শিক্ষা,সে তার নিজ নিয়মেই প্রতিশোধ নেবে
|ছেলেটা এক সকালে খুব ভোরে আমাকে ফোন দিয়েছে। ছয়টা, সাড়ে ছয়টা হবে হয়ত। এতো সকালে কারো ফোন ধরার প্রশ্ন’ই আসে না। তাছাড়া দশটার দিকে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে ইউনিভার্সিটিতে। এরপর চার ঘণ্টার লেকচার।ঘুম চোখে’ই ফোনের দিকে তাকালাম। নাম দেখে ভাবলাম- থাক ধরবো না। কারন এই দুই ভাই’র সাথে আমার যোগাযোগ অনেক দিন ধরে বন্ধ। বছর দুয়েক আগের ঘটনা।
ফোন বেজেই চলেছে। এরপর মনে হলো-কোন বিপদে পড়েনি তো ছেলেটা?
আমি ঘুম থেকে জেগে ফোনটা ধরলাম।- আমি আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাইছি।একটু অবাক হলাম! এতো সকালে এইসব দেশে কেউ ফোন করেনা। আর সে কিনা বলছে এই সকাল বেলা আমার সাথে দেখা করবে! আমি বললাম-কোন সমস্যা হয়েছে তোমার?-আমি কি আপনার বাসায় আসতে পারি?এতো ভোর বেলায় এই ছেলেকে বাসায় আসতে বলার প্রশ্ন’ই আসে না। এরপরও ছেলের গলার আওয়াজ শুনে মনে হলো কোথাও কোন সমস্যা হয়েছে। আমি বললাম-ঠিক আছে, তুমি আসতে পারো।এর ২০ মিনিট পর এই ছেলে ফোন করে বলছে
-আপনি কি সেন্ট্রালে একটু আসতে পারবেন?আমি খুব অবাক হলাম। একটু আগে বলেছে বাসায় আসবে এখন বলছে আমাকে যেতে অত সকালে! যার সাথে আমার অনেক দিন ধরে কোন রকম ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই। আমার অতি অবশ্য’ই যাবার প্রশ্ন’ই আসে না। কিন্তু আমার মনে হলো- ছেলেটার মনে হয় কোন সমস্যা হয়েছে। আমি বললাম-আমি আসছি।
বিছানা থেকে উঠে ওই সকাল বেলাতেই ট্যাক্সি নিয়ে সেন্ট্রালে হাজির হয়েছি। গিয়ে দেখি ছেলেটা কেমন ওলট-পালট কথা বলছে। কথা গুলো আঁটকে যাচ্ছে।আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম ওর মানসিক সমস্যা হচ্ছে। এই ছেলের সাথে এর আগে দীর্ঘ আট মাস কোন কথা হয়নি। তাই বুঝতে পারছিলাম না- কি হলো এই সময়টাতে। আমি তাকে বললাম চলো পাশের দোকানে বসি।বেশিরভাগ দোকান তখনও খুলেনি। পাশে একটা কফি শপে বসে দুজনে মিলে কফি খেলাম। সে তখনও অদ্ভুত সব কথা বলে যাচ্ছে। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম- ওর বোধকরি মানসিক কোন সমস্যা হয়েছে। আমি নিজেই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। সে যেতে চাইছিল না।
এরপর সেখান থেকে তাকে তার হোস্টেলে নিয়ে গেলাম। তার ছোট ভাইকে মেসেজ দিয়ে বললাম- তোমার বড় ভাই মনে হয় অসুস্থ। ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছে- হাসপাতালে ভর্তি করাতে।অথচ এই দুই ভাই’র সঙ্গে এর আগে প্রায় আট থেকে নয় মাস আমার কোন রকম যোগাযোগ’ই ছিল না।আমি চাইলেই সকাল বেলায় ফোনটা না’ই ধরতে পারতাম। চাইলেই সেন্ট্রালে নাও যেতে পারতাম। কিংবা যাবার পর ছেলেটাকে একা ফেলে চলে আসতে পারতাম।
আমার সেইদিন একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল। চার ঘণ্টার একটা লেকচারও ছিল। আমি এর কোনটাতে এটেন্ড না করে বরং এই ছেলেটার ব্যাপার বুঝার চেষ্টা করেছি। তাকে সময় দিয়েছি।কারন আমার কাছে সব সময়’ই মানুষ বড়। একটা মানুষ ভালো থাকলে কিংবা বাঁচলেই না পরে তার সাথে রাগ-অভিমান কিংবা অন্য যে কোন বিষয় আসবে। মানুষ বাঁচলেই না অন্য সব কিছু। সবার আগে মানুষ।
এই ছেলে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে ফিরেছে। সব কিছু স্বাভাবিক। পরের বছর আবারও অসুস্থ হয়েছে। আমাকে ফোন দিয়ে বলছে- আপনি কি একটু আসতে পারবেন?আমি বললাম-কেন?
এরপর মনে হলো কেমন যেন অন্য রকম ভাবে কথা বলছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হয়েছি এবং ওকে সময় দিয়েছি তার ছোট ভাই বাসায় ফেরত আসা পর্যন্ত।আমি জীবন ভর ভেবে এসছি- আমার পারিবারিক, সামাজিক কিংবা নিজস্ব অবস্থান যা’ই হোক; আমি কখনো সেটা ব্যক্তিগত সম্পর্কে কিংবা পারস্পারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিয়ে আসব না। সব সময় এই জন্য চেষ্টা করেছি জীবনকে খুব সাধারণ ভাবে ধারণ করার।এইসব ঘটনারও অনেক আগেএক সন্ধ্যায় এই ছেলের ছোট ভাই এসে আমাকে বলছে-আমার বড় ভাই যদি এখন বিদেশে না আসতে পারে ওর অনেক সমস্যা হয়ে যাবে।তার বড় ভাইর ব্যক্তিগত অনেক বিষয়সহ, পারিবারিক অনেক কিছু ব্যাখ্যা করে এই ছেলে চোখের পানি ফেলে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলেছে- আপনি যদি সাহায্য করেন তাহলে ভাইয়া এই কষ্টের হাত থেকে বেঁচে যায়।
আমি এই ছেলের কান্না আর তার ভাই’র এতো সব কষ্ট শুনে বললাম-আচ্ছা, আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো।
এমন আরও অনেক কিছু বলা যায়। অন্য আর কিছু বর্ণনা করবো না। এর দরকার নেই।অথচ এরা দুই ভাই আমাকে আমার জীবনে সব চাইতে কঠিন বিপদে ফেলে দিয়ে, আমাকে আর চিনতেও পারেনি। হ্যাঁ, ঠিক পড়ছেন, উপরে লেখা এই দুই ভাই’ই!মানুষ যে কতোটা অমানুষ হতে পারে; আমি কোন দিন বুঝতেও পারতাম না, যদি না এদের সঙ্গে আমার পরিচয় হতো। এতোটা অমানুষও কোন মানুষের পক্ষে হওয়া সম্ভব- আমার ভাবতেও গা গুলিয়ে যায়!এদের প্রতি আমার আর কোন রাগ-ক্ষোভ কিছু নেই। এরা এদের মতো বড় হোক, বিশাল কিছু হোক। আমি এদের ক্ষমা করেছি।
এই লেখা লেখার একটা’ই উদ্দেশ্য।আমি বরং এদের কাছে কৃতজ্ঞ এই ভেবে যে- রক্তে-মাংসের মানুষ যে এতোটা অমানুষ হতে পারে; সেটা কেবল গল্প-উপন্যাস কিংবা সিনেমা নাটকে দেখেছি। আমার সৌভাগ্য, এর আগে বাস্তবে কখনো এমন অমানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। সেই অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল।মূল যে শিক্ষাটা আমি পেয়েছি, সেটা হলো- কখনো কারো কাছে নিজেকে পুরোপুরি প্রকাশ করতে নেই। নিজেকে সহজলভ্য করতে নেই। তাহলে মানুষ আপনাকে সস্তা ভাবতে শুরু করবে।এদেরকে ধন্যবাদ- দেরীতে হলেও এই উপলব্ধি’টা আমার মাঝে জাগিয়ে তোলার জন্য।আমি আর কোন দিন এমনকি এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতেও যাবো না। একটা অক্ষরও আর ব্যয় করবো না।আমি জানি প্রকৃতির শিক্ষা বড্ড কঠিন শিক্ষা। সে তার নিজ নিয়মেই প্রতিশোধ নেবে।