আপনি নিজেও জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে অন্যদের কাছ থেকে বৈষম্যর শিকার হবেন
|চারদিকে বোরকা (কিংবা বোরখা) নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।এই বিষয়ে আসার আগে আমি বরং গত কয়দিনে আমার অভিজ্ঞতা গুলো খানিক ব্যাখ্যা করি।আমার দুই ভাগ্নি একটা পেউজ খুলেছে বিদেশে পড়তে যাওয়া বিষয়ক। যারা বিদেশে পড়তে যেতে চায়, তাদেরকে পরামর্শ দেয়া এই পেইজের উদ্দেশ্য।আমি ওদেরকে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে সময় দিচ্ছি বিনা পারিশ্রমিকে। তবে আমার দুই ভাগ্নি যেহেতু ওদের উদ্যোগটাকে মানুষের উপকার করার পাশাপাশি বিজনেস আইডিয়া হিসেবেও নিয়েছে তাই তারা খুব কম পরিমাণে ফী’র বিনিময়ে সেশন গুলোর আয়োজন করছে।
এর মাঝে ওরা আরেকটা আইডিয়া কাজে লাগিয়েছে। ছেলে-পেলে কেউ যদি তাদের ইংরেজি লেভেল জানতে চায় কিংবা স্পোকেন ইংরেজির চর্চা করতে চায়; তাহলে অন লাইনেো সেটা করা যাবে। ওরা আমার সাথে এক ঘণ্টা কিংবা আধ ঘণ্টার একটা সেশনের ব্যবস্থা করে দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি।আমার কাছে আইডিয়া গুলো বেশ পছন্দ হয়েছে। তাছাড়া নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হচ্ছে। ওদের গল্প শুনতে পারছি। আমার মানসিক বিষাদও খানিকটা কেটে যাচ্ছে এভাবে। ভাগ্নিরা আমাকে ব্যাবহার করে ওদের আইডিয়া কাজে লাগাতে পারছে আর আমিও নিজের মানসিক বিষাদ থেকে বের হয়ে আসতে পারছি। মন্দ না ব্যাপারটা।
ওরা এর মাঝে এমন কি তিন সপ্তাহের ইংলিশ স্পোকেন চর্চার একটা তিন সপ্তাহের কোর্সও চালু করে ফেলেছে! ছেলে-পেলেরা আমার সঙ্গে সপ্তাহে তিন দিন ঘণ্টা খানেক ইংরেজি চর্চা করবে ইত্যাদি। আইডিয়া গুলো মন্দ না!তো, গত কয় দিনে বেশ কিছু ছেলে-মেয়ের সাথে কথা হয়েছে।গতকাল একটা ছেলের সাথে কথা বলেছি। সেই ছেলেটা মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছে।আমি তার সাথে ইংরেজিতে কথা বলে যাচাই করার চেষ্টা করছিলাম, ওর ইংরেজির লেভেলটা কেমন।
ছেলেটা আমার বলা প্রতিটা প্রশ্ন বুঝতে পেরেছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে – ওর লিসেনিং এ কোন সমস্যা নেই। সেই সঙ্গে বেশ চমৎকার ভাবেই সব কিছুর উত্তর দিয়েছে।বাংলাদেশ এমন একটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েই গিয়েছে যে- মাদ্রাসায় পড়া ছাত্র-ছাত্রীরা আন-স্মার্ট, এরা পড়াশুনা জানে না; ইংরেজি ভালো করে তো জানার প্রশ্ন’ই আসে না।কেউ কি আমাকে বলবেন- এই ধারণা আসলে কই থেকে প্রতিষ্ঠিত হলো?
তাহলে এই ছেলেটা যে এতো চমৎকার করে উপস্থাপন করল, সে কই থেকে এসব শিখে এসছে?গতকাল শনিবার থাকতে আমি বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি। কারন ছুটির দিন ছিল। এর মাঝে দুটো মেয়েও ছিল। ওদের কথা পরে অন্য কোন লেখায় আলোচনা করা যাবে।গতকাল’ই আমি আরেক’টি ছেলের সাথে কথা বলেছি।ছেলেটার নামের শেষে “বিন” আছে। আমি তাকে বললাম-তোমার নাম অমুক “বিন”?-জ্বি স্যার। এমন নাম কি এর আগে কখনো শুনেছেন?আমি হেসে বললাম-না, সেই অর্থে শুনিনি। এরপর হেসে বলেছি- তবে মিঃ বিন শুনেছি।এরপর ছেলেটা বলেছে-স্যার, এটা খুব নিচু সম্প্রদায়ের একটা টাইটেল। যাদেরকে আমরা আউট কাস্ট বলি।আমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছি-জগতে কোন আউট কাস্ট নেই। এইসব আমরাই বানিয়েছি।
তো ছেলেটা নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছে- স্যার, আমি খুব’ই দরিদ্র সম্প্রদায়ের ছেলে। অনেক কষ্ট করে পড়াশুনা করেছি। আমাদের এখানে কেউ সেই অর্থে পড়াশুনাই করে না। কেউ কোন দিন ইউরোপ-আমেরিকায়ও যায়নি কিংবা বিদেশেও যায়নি। আমার খুব ইচ্ছা বিদেশে পড়াশুনা করতে যাবার।
আমি তার আশপাশ দেখেই খানিকটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। এরপর আমি তার সাথে খানিক সময় ইংরেজি’তে কথা বলেছি।
ছেলেটা যে কি চমৎকার করে ইংরেজিতে আমার সঙ্গে কথা বলল। এক জীবনে আমি অনেক ছাত্র-ছাত্রীর ইন্টার্ভিউ নিয়েছি কেবল এডমিশন ইন্টার্ভিউ’র জন্য। এই ছেলের মতো এতো ধীর-স্থির ভাবে প্রতিটা খুটি-নাটি বিষয় এতো চমৎকার ভাবে ব্যাখ্যা করতে আমি অন্তত এর আগে শুনিনি। আমি ওর কথা শুনে এতোটাই বিমোহিত হয়েছি যে- আমি ভাবছিলাম ওর মতো থাকতে, আমি নিজে কি এতো চমৎকার ইংরেজি বলতাম?
ইংরেজি বলতে পারাটাকে আমি কখনোই ভালো কিংবা খারাপ ছাত্রের পাল্লায় মাপি না। কিন্তু একটা ভাষা চমৎকার ভাবে বলতে পারাটা তো একটা স্কিল। যেটা সবার থাকে না।এখন আপনি যদি একটা ছেলে মাদ্রাসা থেকে পড়ে এসছে, কিংবা একটা ছেলে ময়মনসিংহের অজপাড়া গাঁয়ের আউট কাস্ট থেকে উঠে আসা বলে -তাকে প্রথমেই বাতিলের খাতায় ফেলে দেন- তাহলে সে তার প্রতিভা কিংবা মেধা কি করে প্রকাশ করবে?এটাকেই তো বৈষম্য বলে।
কেউ একজন ঢাকার বাইরের ইউনিভার্সিটিতে পড়ে আসা মানে কিছু জানে না! প্রাইভেটে পড়া মানে সার্টিফিকেট কিনেছে! ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার আবার কিসের ইঞ্জিনিয়ার! জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবার পড়াশুনা হয় নাকি! গ্রামের ছেলে মানে ইংরেজি বুঝে না! মাদ্রাসার ছেলে-পেলেরা আনস্মার্ট! এই সব ভেবে যদি আপনি কাউকে ইন্টার্ভিউ’ই না নেন। কিংবা নেবার সময় আগে থেকেই একটা নেতিবাচক ধারণা
পোষণ করে থাকেন; তাহলে তো কোন দিনও সঠিক ভাবে মেধা যাচাই করা যাবে না।বড় বড় ইউনিভার্সিটি কিংবা নাম করা স্কুল-কলেজে পড়া মানেই ভালো, আর অন্য কোথাও কিছু হয় না; এই ধারণাকেই তো বৈষম্য বলে।আমি নিজেই তো ঢাকার নামকরা স্কুল-কলেজে পড়েছি। আমি হলফ করে বলতে পারি, উপরে যেই দুটো ছেলের কথা বললাম, এরা আমি এবং আমার বেশিরভাগ বন্ধু-বান্ধবের চাইতে মেধায় হয়ত এগিয়ে। সুযোগ পেলে এরা আরও অনেক ভালো করবে।
যা হোক, গত কয় দিন ধরে ফেসবুকে বোরকা পড়া এক মা তার সন্তানের সাথে ক্রিকেট খেলছে এমন একটা ছবি ঘুরে ফিরছে।বরাবরের মতো এইবারও সবাই দুই দলে ভাগ হয়েছে!একদল বলছে- ছিঃ ছিঃ, এই মহিলা বোরকা পড়ে কিনা ক্রিকেট খেলছে! মেয়ে হয়ে সে কি করে এইসব করতে পারে!আরেকদল বলছে- ছিঃ ছিঃ, দেশটা পাকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে গেল! বোরকা পড়ে এখন ক্রিকেট খেলতে হচ্ছে!
জাত গেল, জাত গেল!কেন? আপনাদের সমস্যা কোথায়?
সে বোরকা পড়ে ক্রিকেট খেলবে নাকি শাড়ি পড়ে; সেটাও কি আপনাদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে করতে হবে?সে ক্রিকেট খেলবে নাকি ঘরে বসে হাউজ ওয়াইফ হবে; সেটাও আপনাদের ঠিক করে দিতে হবে?আপনার বলে দিবেন- কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ; আর সেই অনুযায়ী অন্যদের চলতে হবে?এভাবেই অসহনশীল এবং বৈষম্যের সমাজ গড়ে উঠে।আপনারা যারা এইসব নিয়ে এখন আলোচনা-সমালোচনা করছেন; নিশ্চিত জেনে রাখুন এই মানসিকতা ধারণ করার কারনে, আপনি নিজেও জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে অন্যদের কাছ থেকে বৈষম্যর শিকার হবেন।